শিশুদের লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সার

আক্ষরিক অর্থে লিউকেমিয়া শব্দের অর্থ শাদা রক্ত। তবে লিউকেমিয়া রোগীদের রক্তের রঙ কিন্তু শাদা নয়, লাল। এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য রক্তে অপরিণত সাদা কণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। তাই এর নাম লিউকেমিয়া বা সাদা রক্ত। ১৮৪৭ সালে ভেলপিউ নামে এক ফরাসি চিকিৎসক এই রোগের বিবরণ দেন, তবে ভিরকাউ নামে এক জার্মান চিকিৎসাবিজ্ঞানী এই রোগের নাম দেন লিউকেমিয়া বা সাদা রক্ত। সাধারণভাবে লিউকেমিয়াকে রক্তের ক্যান্সার বলা হয়। ক্যান্সারের মতোই এই রোগে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয় এবং অপরিণত কোষগুলো স্বাভাবিক কোষকে ধ্বংস করে। এর নাম রক্তের ক্যান্সার হলেও এই রোগের উৎপত্তি যেখানে রক্ত তৈরি হয় সেই অস্থিমজ্জায়।

দুই রকম লিউকেমিয়া দেখা যায়-
১. একিউট এবং
২. ক্রনিক

কারণ :
এই রোগের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে কয়েকটি তথ্য জানা গেছে যার ফলে হয়তো ভবিষ্যতে এই কারণ জানা যাবে। এই তথ্যগুলো

  • বিকিরণের ফলে এই রোগ হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর জীবিতদের মধ্যে এই রোগের হার খুব বেশি। যারা রঞ্জনরশ্মি নিয়ে কাজ করে তাদের মধ্যেও এই রোগের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু রাসায়নিক পদার্থ যেমন বেনজিন ব্যবহারে এই রোগ হতে পারে।
  • কিছু ওষুধ যেমন ব্যথা নিরোধক ফিনাইল বুটাজোন বা, জীবাণুনাশক ক্লোরামফিনিকলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিউকেমিয়া হতে পারে।
  • জিনবাহিত কিছু অসুখের সাথে যেমন ডাউন্স সিনড্রোমের সাথে লিউকেমিয়ার সম্পর্ক আছে।
  • অনেকে মনে করেন কোনো ভাইরাস এই রোগের কারণ হতে পারে।

সাধারণভাবে বলা যায় লিউকেমিয়া বংশগত বা ছোঁয়াচে নয়, যদিও একই পরিবারের একাধিক লোকের এই রোগ হতে দেখা গেছে।
বয়সঃ বয়স ৫ থেকে ২০ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই এই রোগ বেশি হয়। যদিও যেকোনো বয়সে এই রোগ হতে পারে। এমনকি নবজাতক শিশু লিউকেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে।

লক্ষণ :
এই রোগের কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ আছে-

  • দীর্ঘস্থায়ী জ্বর
  • গাঁটব্যথা
  • ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
  • শরীরের নানা স্থানে মশার কামড়ের মতো দাগ
  • কালশিটে পড়া
  • শরীরের নানা স্থানে রক্তপাত যেমন দাঁত ও মাঢ়ি দিয়ে, কাশির সাথে প্রস্রাবের সাথে, পায়খানার সাথে
  • মুখে ঘা, দুর্বলতা, কানে ব্যথা ইত্যাদি।

শারীরিক পরীক্ষা করলেঃ

  • রক্তস্বল্পতা
  • শরীরের নানা স্থানে গ্রন্থির বৃদ্ধি হাড়ে ব্যথা
  • প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধি
  • চোখের ভেতরে রক্তপাত দেখা যায় অনেক সময়।

কখনো কখনো কয়েকটি অসুখের সাথে লিউকেমিয়ার ভুল হতে পারে। যেমন
রিউম্যাটিক ফিবার, টিবি ইত্যাদি। এবং রক্ত ও অস্থিমজ্জার পরীক্ষা ও কয়েকটি বিশেষ রাসায়নিক পরীক্ষার দ্বারা সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

চিকিৎসা-
চিকিৎসার ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় এক সময় রোগ নির্ণয়ের ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে মৃত্যু ছিল অবধারিত। ১৯৪৮ সালে উত্তর আমেরিকার ডা: সিডনি ফারবার এবং ডা: সুব্বা রাওয়ের নতুন ওষুধ আবিষ্কারের ফলে লিউকেমিয়া রোগাক্রান্ত শিশুদের ভবিষ্যৎ আজ উচ্ছ্বল। ৫০ বছর পরে একাধিক নতুন ও কার্যকরী ওষুধের আবিষ্কার এবং ব্যবহারের ফলে মৃত্যুকে অনেকাংশে জয় করা সম্ভব হয়েছে।
চিকিৎসার দুই, তিন বা চার প্রকারের ওষুধ একসাথে কিছু দিন এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ ব্যবহারের সাথে সাথে জীবাণুনাশক ওষুধ এবং রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। লিউকেমিয়া রোগের চিকিৎসা তিন থেকে পাঁচ বছর করা হয়। রোগ নিরাময়ের পর আবার রোগের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বিশেষ কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রয়োজন। এর জন্য মেরুন্দও বিকিরণ এবং অস্থিমজ্জা সংযোজন প্রয়োজন হতে পারে। উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার ফলে শিশুদের লিউকেমিয়া যেমন অ্যাকিউট লিমিরাসটিক ৯০ শতাংশ ভালো হয়ে যায়।
এখন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের অনেক শিশু এই রোগে আক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর বাবা- মায়েরা ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসা করান। যার ফলে আক্রান্ত শিশুর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি; ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়।

Scroll to Top